শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ পূর্বাহ্ন
কালের খবর ডেস্ক :: কক্সবাজারে জেলা পুলিশের অভিযানে উদ্ধার করা হয় ১০ লাখ ইয়াবা। কিন্তু এর মধ্যে ৯ লাখ ৯০ হাজারই মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশের একটি দল। পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্তে তার সত্যতাও পাওয়া গেছে। তদন্তে জেলা পুলিশ সুপার, দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ পুলিশের ১২ সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ প্রশাসন।
জানা যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ১১ জন এখনো কক্সবাজারেই দায়িত্ব পালন করছেন। একজন আছেন চট্টগ্রামে। এই বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি সুপারিবাগানে ইয়াবাগুলো রাখা ছিল। কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তা উদ্ধার করে।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়াবা উদ্ধারের পর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই বশির আহম্মাদ মুঠোফোনে এবং পুলিশ পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র সরকার নিজে পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে জানান, অভিযানে ৭ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের এসআই জাবেদ আলম বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় যে মামলা করেন, তাতে মাত্র ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়। পরে তদন্তে প্রমাণ হয়, তাঁরা আসলে ১০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছিলেন ওই দিন। বাকি ৯ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা তাঁরা একজন মাদক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে বিক্রি করে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের দুই কর্মকর্তার বিরোধের কারণে ঘটনাটি ফাঁস হয়। ওই সময় গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত বশির আহম্মাদ নামের এক উপপরিদর্শক এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, তিনি ছুটিতে ঢাকায় থাকার সময় অভিযুক্ত এক কর্মকর্তা তাঁর মুখ বন্ধ করার জন্য ঘুষ দিতে তাঁর বাসায় আসেন। একটি দৈনিক পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়। পুলিশের অন্য একটি দল এ ঘটনা তদন্ত করে ঘুষ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর তদন্ত করছে, সেটা নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না। তবে পুলিশ সুপার হিসেবে আমি এটা বলতে পারি, জ্ঞাতসারে আমি কোনো অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত নই।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাইলাউ মারমা বলেন, ‘আমি কাগজে-কলমে যা পেয়েছি, সেটার তদন্ত করেছি। তদারকির কাজে কোনো অবহেলা করিনি।’
পুলিশের তদন্তে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। মনিরুল এখন সৈকত পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে আছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মনিরুল ইসলাম ৯ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবা বড়ি বিক্রি করার কথা জানতেন। শুধু তা-ই নয়, এর আগে তিনি ৫০০ ইয়াবাসহ একটি ফ্রিজ জব্দ করেন এবং পরে তা বিক্রি করে দেন। একটি মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা একটি মাইক্রোবাস তিনি নিজে ব্যবহার করেন। তিনিই ১০ লাখ ইয়াবা নিয়ে অভিযোগ করা কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে এসআই মাসুদ রানাকে তাঁর বাসায় পাঠান।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, এটা আসলে দুই দারোগার মধ্যে বিরোধের কারণে হয়েছে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। ঘটনা যা নয়, তা-ই বলা হচ্ছে।
পরিদর্শক সুকেন্দ্র চন্দ্র সরকার বর্তমানে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত। অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমি করিনি। যে করেছে, তার নামই আসেনি।’
উপপরিদর্শক জাবেদ আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উদ্ধার করা ইয়াবা তিনি বিক্রি করেছেন। আর এসআই মাসুদ রানা অভিযোগকারী দারোগা বশির আহম্মাদের মুখ বন্ধ করতে তাঁর বাসায় ঘুষ দিতে গিয়েছিলেন। এসআই কামাল হোসেন ভুল মামলা দায়েরে সহযোগিতা করেন। তিনিও ইয়াবা বিক্রির টাকার ভাগ পান।
অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে উপপরিদর্শক কামাল হোসেন এখন কক্সবাজার পিবিআইতে বদলি হয়েছেন। অন্য সব কর্মকর্তাও কক্সবাজার জেলাতেই কর্মরত আছেন।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি তাঁর দপ্তরে এসেছে। এতে যাঁদের নামে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে। মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রত্যাহার না করার বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ধরনের অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে-জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ বলেন, এ ধরনের গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে আগে সবাইকে প্রত্যাহার করা উচিত। তারপর তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এমন ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ারও নজির আছে।